প্রবন্ধ রচনা: শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস | রচনা ছাত্ররাজনীতি | ছাত্ররাজনীতির সুফল ও কুফল রচনা

শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস

এছাড়াও আরো যে বিষয় সম্পর্কে লিখতে পারবে:
👉ছাত্ররাজনীতি
👉আমাদের রাজনীতি ও ছাত্রসমাজ
👉ছাত্ররাজনীতির সুফল ও কুফল
👉ছাত্ররাজনীতি ও সন্ত্রাস

ভূমিকা :

বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি একটি আলােচিত ও সমালােচিত বিষয় । এর যেমন প্রশংসনীয় দিক রয়েছে তেমনি নিন্দনীয় দিকও রয়েছে । বস্তুত বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি আজকের দিনে জাতির জন্যে অত্যন্ত দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে । সুমহান ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও ছাত্ররাজনীতি বন্ধের জন্যে জোরালাে জনমত সৃষ্টি হয়েছে । এখন ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছে ।

ছাত্ররাজনীতি কী :

ছাত্ররাজনীতি বলতে বােঝায় ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠিত আন্দোলন- যা ছাত্রসমাজের অধিকার ও যুক্তিসঙ্গত দাবি - দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে পরিচালিত হয় । বৃহত্তর অর্থে , সচেতন ছাত্রসমাজ কর্তৃক পরিচালিত সংগঠনের নির্দেশে ও নেতৃত্বে পরিচালিত রাজনৈতিক কার্যক্রম । জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন জনস্বার্থ বিষয়েও ছাত্রদের মতামত দান ও ভূমিকা পালনও ছাত্ররাজনীতির অংশ । তবে ছাত্ররাজনীতি মূলত ছাত্রসমাজের স্বার্থকেন্দ্রিক হওয়াই যুক্তিযুক্ত ।

বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির প্রবণতা :

ছাত্রসংগঠনগুলাে স্বনির্ভর , স্বকীয় কর্মসূচিকেন্দ্রিক হবে এটাই কাঙিক্ষত । তবে ঐতিহাসিকভাবে এদেশের ছাত্ররাজনীতি জাতীয় রাজনীতিরই স্রোতােধারাকেন্দ্রিক । মূল রাজনৈতিক সংগঠনগুলাের অন্যতম শাখা সংগঠন বা অঙ্গসংগঠন হিসেবেই ছাত্ররাজনীতি পরিচালিত হয়েছে । তবে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে ছাত্রসংগঠনগুলাে অভিন্ন কর্মসূচিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে । এদেশের ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের স্বার্থের চেয়ে জাতীয় রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে এবং মূল সংগঠনগুলাের দৃষ্টিতেই বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুকে গ্রহণ করেছে । ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও কতিপয় ছাত্র সংগঠন হানাদার বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে গণহত্যায় অবতীর্ণ হতে দ্বিধা করে নি । মূল রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনরূপে বর্তমানে আওয়ামী লীগের বাংলাদেশ ছাত্রলীগ , জাসদের ছাত্রলীগ ( জাসদ ) , জাতীয়তাবাদী দলের জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল , কমিউনিষ্ট পার্টির ছাত্র ইউনিয়ন , জামায়াতে ইসলামীর ইসলামী ছাত্র শিবির প্রভৃতি সক্রিয় হয়েছে ।

বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির সূচনা :

বাংলাদেশের ছাত্ররা সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে স্বদেশী আন্দোলনের সময় । এ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক অনেক গােপন সমিতি গড়ে উঠে এবং তাতে যুক্ত হয়ে ছাত্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহ করে । সূর্যসেন , পুলিন বিহারী দাস , বাঘা যতীন , ক্ষুদিরাম , প্রফুল্ল চাকী , বীনা দাস , সুনীতি চৌধুরী , শান্তি ঘােষ প্রমুখ বিপ্লবীর প্রায় সবাই ছিলেন ছাত্র - ছাত্রী বা শিক্ষক । ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ছাত্ররাজনীতি সাংগঠনিক রূপ পরিগ্রহ করে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর স্থানীয় রাজনৈতিক দল গঠিত হবার ফলে জন্ম হয় ছাত্র সংগঠনের ।

ছাত্ররাজনীতির অবদান :

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ বিভিন্ন ইস্যুতে অবিমরণীয় ভূমিকা পালন করেছে । নিম্নে ছাত্রসমাজের রাজনৈতিক সচেতনতার ফসল হিসেবে বিভিন্ন ইস্যু ও আন্দোলনে তাদের অবদানের ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করা হলাে :

ভাষা আন্দোলন: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করার পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্ৰ সৰ্বমুখী বৈষম্যনীতি চাপিয়ে দেয় বাংলার মানুষের ওপর । এর অংশ হিসেবে বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা চালায় । শুন্য থেকেই এর বিরুদ্ধে রুখে সাঁড়ায় এদেশের ছাত্রসমাজ । ধারাবাহিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় ছাত্ররা , তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে দাঁড়ায় অগ্নিগর্ভ এক দুর্গ । ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ' বলে গর্জে উঠেছিল বাংলার সংগঠিত ছাত্রসমাজ । অকাতরে তারা প্রাণ দিয়ে সেদিন ছিনিয়ে এনেছিল মাতৃভাষার সম্মান ।

৬২ - এর শিক্ষা আন্দোলন :১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন এদেশের স্বার্থবিরােধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলে ছাত্ররা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে । ছাত্রদের এ আন্দোলন শাসকগােষ্ঠীর দুরভিসন্ধি মাটি করে দেয় ।

৬৯ - এর গণআন্দোলন : পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে উত্তাল গণআন্দোলনের প্রাণপ্রবাহ হয়ে দাড়ায় এদেশের সচেতন ছাত্রসমাজ । ছয় দফা আন্দোলন ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা - বিরােধী আন্দোলনের পটভূমিতে ছাত্ররা পেশ করে ১১ দফা দাবি । এ ১১ দফা আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর নীতি গ্রহণ করলে সারাদেশ এ সময় উত্তাল আন্দোলনে টালমাটাল হয়ে পড়ে । পুলিশের গুলিতে মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড . শামসুজ্জোহা । এর ফলে দেশব্যাপী দুর্বার গণঅভ্যুত্থান শুরু হয় । ১১ দফা আন্দোলনের সূত্র ধরে সারাদেশ অগ্নিমন্ত্রে জেগে উঠে ।

৭১'র মুক্তিযুদ্ধ : ৭০'র নির্বাচনে জনমত গঠনে ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । ২৫ মার্চের কালােরাতের পর সশস্ত্র প্রতিরােধ শুরু হলে ছাত্ররা মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেয় এবং অকাতরে দেশমাতৃকার জন্যে জীবন দান করে । হাজার হাজার ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয় । দেশের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের অবদান জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে ।

৯০ - এর দশকে স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলন : সর্বশেষ বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ ৯০ - এর দশকে স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তােলে । স্বৈরাচারের লেলিয়ে দেওয়া পেটুয়া বাহিনীর হাতে সেলিম , দেলােয়ার , জেহাদসহ অনেকে প্রাণ দেয় । স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সকল ছাত্র সংগঠন ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচিতে এগিয়ে যায় এবং জাতীয় রাজনীতির গতিপথ তৈরি করে । অবশেষে স্বৈরাচারের পতন ঘটে ।

ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষাঙ্গণে সন্ত্রাস :

সােনালি অতীত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে সন্ত্রাসের অপচ্ছায়া দীর্ঘদিন যাবৎ জাতির জন্যে দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । স্বাধীনতা পূর্বকালে ছাত্রসংগঠনগুলাের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও তা মারাত্বক সহিংসতায় রূপ নেয় নি । স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে সন্ত্রাসী হামলায় সাত জন ছাত্র প্রাণ হারায় । এরপর থেকে ছাত্ররাজনীতিতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে থাকে । সংবাদপত্রের হিসেব অনুযায়ী , ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে শিক্ষাঙ্গনে সহিংস ঘটনায় ১২৮ জন ছাত্র প্রাণ হারিয়েছে এবং মারাত্মক জখম হয়েছে ৪২৯০ জন । গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারী সরকার ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয় । অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলােও অস্ত্রের ভাষাতেই তার জবাব দেয় । ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে অস্ত্রের ভাণ্ডার তৈরি হয় এবং পবিত্র শিক্ষাঙ্গণে সশস্ত্র সংঘাত মারাত্মক আকার ধারণ করে । ছাত্র সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলাে বার বার অনির্ধারিতভাবে বন্ধ হয়ে যায় । ফলে সৃষ্টি হয় সেশন জট । শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপনের আগেই তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের বয়স চলে যায় ।

ছাত্ররাজনীতির বর্তমান অবস্থা :

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি এখনাে সুস্থ ধারায় ফিরে আসে নি । ছাত্রসংগঠনগুলাে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলাের লেজুড়বৃত্তিতে মত্ত । রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছাত্ররা আজ অত্রবাজি , টেন্ডারবাজি , তদবিরবাজি , খুন - রাহাজানি , মাস্তানি , ছিনতাই এমন কোনাে অপকর্ম নেই যা করে না । সম্প্রতি রাজধানীতে দিবালােকে টাকা ছিনতাইকালে দুজন ছাত্রনেতা গ্রেফতার হবার পর ছাত্ররাজনীতির নামে অপকর্মের নানা কাহিনী বেরিয়ে আসে । কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র নেতার ধর্ষণের সেঞ্চুরি পূর্ণ করার ঘােষণায় দেশব্যাপী আলােড়ন সৃষ্টি হয় । এসব ছাড়াও দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রতিদিন সংঘাত - হানাহানি ঘটছে । তাই বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে জনগণের নেতিবাচক মনােভাব জোরালাে হয়েছে । সর্বমহল থেকে বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ বা বন্ধ করার জোর দাবি উঠেছে ।

উপসংহার :

বাঙালির যা কিছু অর্জন তার কৃতিত্বের অনেকখানি ছাত্রসমাজের প্রাপ্য । ছাত্ররাজনীতির সুমহান ঐতিহ্য আজ আর নেই । বর্তমানে ছাত্ররাজনীতিতে যা চলছে তা জাতির সার্বিক উন্নতির জন্যে উদ্বেগ বয়ে এনেছে । বর্তমানে আইন করে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে । জাতীয় রাজনীতির অসুস্থ ধারাকে ছাত্ররা যেভাবে বয়ে বেড়াচ্ছে তাতে আমাদের আগামী প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে । দেশের মানুষ ছাত্ররাজনীতির নামে আর রক্তপাত ও সংঘাত দেখতে চায় না । জাতি ছাত্রদের হাতে বই - খাতা - কলম দেখতে চায় । প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও নেতাদের জাতির এ মনােভাবের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে ।


আরো পড়ুন: