বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম রচনা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম

ভূমিকা:

স্বাধীনতাহীনতায় কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে চায় না। কবির ভাষায়-

"স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়।"

বাংলার মানুষও পরাধীনতাকে মেনে নিতে চায় নি। কিন্তু স্বাধীনতা এমনিতেই অর্জিত হয় নি। লক্ষ প্রাণের তাজা রক্তের বিনিময়ে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা-সূর্য। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল ও গৌরবের অধ্যায় হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।

দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন:

১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষের স্বাধিকারকে মেনে নেয়। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। তৎকালীন মুসলিম নেতৃবৃন্দের অদূরদর্শিতা ও অসাধুতায় বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ধর্মীয় ঐক্যের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একক রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্তি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল।

বাংলার ওপর শোষণ ও বৈষম্য:

স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্লজ্জ শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হয়। জনসংখ্যা ও সম্পদে বাংলাদেশের প্রাধান্য থাকলেও এদেশের মানুষ তাদের ন্যায্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এদেশের সম্পদ দিয়ে গড়ে তোলা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভিত। সেনাবাহিনী, সিভিল সার্ভিস প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঙালির প্রবেশাধিকার প্রায় বৃদ্ধ করা হয়। বাঙালি রাজনীতিবিদদের যোগ্যতার প্রতিও কোনো সম্মান প্রদর্শন করা হয় নি। শোষণ ও বৈষম্যের নীতি অনুযায়ী বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের অপমৃত্যু ঘটাতে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হয়। ফলে বাংলার মানুষ মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা হরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাপ্রেমী তরুণদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। শহিদ হন সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক প্রমুখ। ভাষাকে উপলক্ষ্য করে বাংলার মানুষের মাঝে দেখা দেয় নতুন জাতীয় চেতনা তথা স্বাধিকারের প্রেরণা।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের নির্বাচন:

শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমনে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ১৯৬৯ সালে বিস্ফোরিত হলো। সারাদেশ ভাসতে থাকে আন্দোলনের অগ্নিস্রোতে। গণঅভ্যুত্থান ও তীব্র আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। অবশেষে এল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে ভোট দেয়। আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। রাষ্ট্র শাসনের অধিকার পেল আওয়ামী লীগ। কিন্তু স্বাধীনতাকামী জনগণের এ গণতান্ত্রিক রায়কে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা শাসকরা মেনে নিল না। ক্ষমতা হস্তান্তরে শুরু করল টালবাহানা। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যের সমাবেশ ঘটালো। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হলো ইতিহাসের ঘৃণ্যতম হত্যাযজ্ঞ।

স্বাধীনতার ঘোষণা:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসমুদ্রে ঘোষণা করেন 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' শুরু হয়ে যায় সর্বাত্মক প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম।

অস্থায়ী সরকার ও মুক্তিবাহিনী গঠন:

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় গঠিত হয় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার। জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানীর নেতৃত্বে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স, পুলিশ, আনসার, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। এতে দেশের ছাত্র-তরুণসহ সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর দেশব্যাপী চালাতে থাকে হত্যা, লুটতরাজ ও ধর্ষণ। মুক্তিবাহিনীও দেশমাতৃকার স্বাধিকার অর্জনে চালায় প্রাণবাজি লড়াই।

সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়:

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের আপামর জনগণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা হামলায় হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিবেশী ভারতসহ অন্যান্য দেশ সাহায্যের হাত বাড়ায়। ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া হলো প্রশিক্ষণ। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সরাসরি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। শুরু হয় যৌথ আক্রমণ। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণে ৪ ডিসেম্বর হতে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে পাকবাহিনী তাদের সবগুলো বিমান হারায়। যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটে। যৌথবাহিনী ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে ফেলে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে শত্রুমুক্ত হয়। ১৪ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী ঢাকার মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান নেয়। ১৬ ডিসেম্বর সকাল দশটায় যৌথবাহিনী ঢাকার মিরপুর ব্রিজের কাছে পৌঁছালে পাকিস্তানি জেনারেল জামশেদ আত্মসমর্পণ করেন। যৌথবাহিনী সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে ঢাকা নগরীতে প্রবেশ করে। এদিনই বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দানে) পাকবাহিনীর অধিনায়ক লে. জেনারেল নিয়াজী তার ৯৩ হাজার অনুগত সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এদিন বিশ্বের বুকে ঠাঁই করে নিল নতুন একটি মানচিত্র নতুন একটি দেশ 'বাংলাদেশ"।

উপসংহার:

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবের ইতিহাস, সাফল্যের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল দেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে না দেওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে উঠবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের সমাজকে গড়ে তুলতে হবে।


আরো পড়ুন: