বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন রচনা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন 

ভূমিকা:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে স্বাধীনতা লাভে যাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তারা হলেন আমাদের বিদেশি বন্ধুগণ। বিদেশি বন্ধুদের আন্তরিক সমর্থন ও সাহায্যের কারণে এত স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিদেশি বন্ধুদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ভিনদেশি এসব মানুষের কাছে বাংলাদেশ চিরঋণী। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ সকল মহান ব্যক্তি ও সংগঠনের অবদান বাঙালি জাতিকে প্রাণপণ লড়াইয়ে উৎসাহ জুগিয়েছিল।

ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ:

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক সমর্থন পেয়েছিল তা বোঝার জন্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করা অপরিহার্য। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক, ভাষাগত এবং অর্থনৈতিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হয়ে ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তাতানের উপর প্রান্তিক নিপীড়ন শুরু করে, যার ফলে ব্যাপক অসন্তোষ এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবি ওঠে। ১৯৭১ সালের মার্চে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ওপর পাকিস্তান সরকারের নৃশংস দমন-পীড়ন নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্ম দেয়

আন্তর্জাতিক সমর্থন:

ভারত: বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যুদ্ধের সহিংসতা থেকে বাঁচতে ভারতে পালিয়ে আসা লক্ষাধিক বাঙালি শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করে এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন: সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে জোরালোভাবে সমর্থন করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সহায়তা প্রদান করে। সোভিয়েত ইউনিয়নও মুক্তিবাহিনীকে (বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মি) অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছিল এবং যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে সাহায্য করেছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: পাকিস্তানের সাথে মিত্রতার কারণে বাংলাদেশকে সমর্থন করতে প্রথমে দ্বিধা বোধ করলেও, পাকিস্তানি নৃশংসতার প্রতিবেদন প্রকাশের সাথে সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে তার মতবাদ পরিবর্তন করে। আমেরিকার জনমত বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে, সরকারকে পদক্ষেপ নিতে চাপ দেয়। অবশেষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি যুদ্ধবিরতি এবং পাকিস্তানি বাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের একটি প্রস্তাব সমর্থন করে।

জাতিসংঘ: জাতিসংঘ যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মানবিক সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি ভারতে লক্ষ লক্ষ বাস্তুচ্যুত বাঙালি উদ্বাস্তুদের সাহায্য ও ত্রাণ প্রদান করেছে। জাতিসংঘ ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনার সুবিধাও দেয়, যার ফলে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয় এবং বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (NAM): মিশর, যুগোস্লাভিয়া এবং আলজেরিয়া সহ ন্যাম সদস্য দেশগুলি বাংলাদেশের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে এবং পাকিস্তানের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছে। তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ওকালতি করে, পাকিস্তানের আগ্রাসন বন্ধ করতে চাপ দেয়।

মানবিক সংস্থা: রেড ক্রস এবং অক্সফামের মতো অসংখ্য আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জনগোষ্ঠীকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করেছে। তারা সংঘাতের সময় বাাংলাদেশে দুর্ভোগ কমিয়ে শরণার্থীদের চিকিৎসা সহায়তা, খাবার এবং আশ্রয় দিয়েছিল।

উপসংহার:

জাতি ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমর্থন না পেলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল হতো না। ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দেশগুলি সামরিক সহায়তা এবং কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ এবং ন্যাম সদস্য দেশগুলি কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং মানবিক সহায়তার মাধ্যমে সংকট সমাধানে অবদান রেখেছে। তদুপরি, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জনসংখ্যার তাৎক্ষণিক প্রয়োজনগুলিকে মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিভিন্ন জাতি ও সংস্থার সম্মিলিত সমর্থন শুধু বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করেনি বরং ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের জন্য লড়াইয়ে বৈশ্বিক সংহতির গুরুত্বও তুলে ধরেছে।


আরো পড়ুন: