পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার

ভূমিকা :

সুস্থ পরিবেশে সুস্থ জীবন এখন আর নেই । স্রষ্টা প্রদত্ত প্রকৃতির রাজ্য আজ বিপন্ন । সেই সাথে মানবজীবন ও প্রাণিজগৎ আজ ধ্বংসেন্মুিখ । কিন্তু এমনটি পূর্বে কখনো ছিল না । মানুষ নামের যন্ত্রদানব প্রকৃতির শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করে ফেলেছে । তাদের কারণেই শান্ত পৃথিবী আজ দূষণের ছােবলে আক্রান্ত ।

পরিবেশ ও পরিবেশ দূষণ কী :

মানুষ চারপাশের যা কিছু নিয়ে বাস করে তা - ই তার পরিবেশ । অর্থাৎ , মানুষের জীবনযাপনের উপকরণ ও ক্ষেত্র সবকিছুই পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত ।আর যে পরিবেশে মানবজীবনের স্বাভাবিক বিকাশ বিঘ্নিত হয় এবং প্রাণিকুল বিপন্নবােধ করে তাকেই দূষিত পরিবেশ বলা হয় ।

পরিবেশ দূষণের বিরূপ প্রভাব ও বাংলাদেশ :

জলে - স্থলে - অন্তরীক্ষে এবং অসীম বায়ুমণ্ডলে আজ দূষণ প্রক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে । মানুষের মল - মূত্র যেমন পানি ও বাতাসকে দূষিত করছে তেমনি কারখানার বর্জ্য নদী ও সমুদ্রের পানিকে প্রাণিকুলের বসবাসের অযােগ্য করে তুলেছে । তাছাড়া সাবমেরিনে রাসায়নিক ও পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার বিশ্বের জলরাশিকে বিষিয়ে তুলেছে । আজ বাতাসে বৃদ্ধি পেয়েছে কার্বন ডাই - অক্সাইড । উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে আবহাওয়ামণ্ডল । উত্তপ্ততার কারণে ফুলে উঠেছে সমুদ্রবক্ষ । দেখা দিয়েছে গ্রিন হাউস ইফেক্ট । বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া । পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার কারণে অতিবৃষ্টি , অনাবৃষ্টি , অকালবন্যা বা ঝড় - জলােচ্ছ্বাসে মর্তবাসী প্রায়শ বিপন্ন হয়ে পড়ছে । যানবাহন ও কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসে মানুষ ক্যান্সার , শ্বাসকষ্টের মতাে দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে । তাছাড়া শব্দদূষণের কারণে মানুষের স্নায়ুবিক বৈকল্য দেখা দিয়েছে । পরিবেশ দূষণের এই বৈশ্বিক ভয়াবহতা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয় । উপরন্তু অতিরিক্ত জনসংখ্যা , অসচেতনতা ও সীমিত বনজ সম্পদের কারণে বাংলাদেশ পরিবেশ দূষণের অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে ।

পরিবেশ দূষণের কারণ :

পরিবেশ দূষণের কারণ অনেক । তবে নিম্নলিখিত কারণগুলােকে মুখ্য হিসেবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি ।
ক . অবাধ শিল্পায়ন : শিল্পায়নের কারণে প্রতিদিন বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ বাড়ছে । এ বর্ধিত বর্জ্য পদার্থ বিশ্বের পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছে । বর্জ্য অপসারণ ও নির্মলে শিল্প মালিকদের দায়িত্বহীনতা এ সমস্যাটিকে গুরুতর করে তুলেছে ।
খ. জনসংখ্যার বিস্ফোরণ : অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশের জন্যে সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে । বিপুল জনগােষ্ঠীর মুখের আহার যােগাড় করার জন্যে বন - জঙ্গল সাফ করে আবাদি জমিতে পরিণত করতে হচ্ছে । এতে পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে । তাছাড়া মানুষের মল মূত্র , কফ - কাশি বাতাস ও পানিকে দূষিত করছে । অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার পরিবেশকে বিপন্ন করছে ।
গ. অস্ত্র প্রতিযােগিতা : পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের অবাধ ব্যবহার পরিবেশের জন্যে হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে । প্রায়ই সমুদ্র ও ভূগর্ভে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানাে হচ্ছে । যুদ্ধের সময় পরমাণু বা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার বিশ্বের পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলেছে । পরমাণু চুল্লির বর্জ্য ও পরিত্যক্ত অসামগ্রী আজ সবচেয়ে বড় পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি করেছে । ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ার চেরনােবিলে পরমাণু দুর্ঘটনা থেকে প্রচুর পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে ।
ঘ . যান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার : তরল জ্বালানিচালিত যানবাহনের অবাধ ব্যবহার আবহাওয়াকে দূষিত করে তুলেছে । যানবাহনের বিষাক্ত কালাে ধোঁয়া বিষাক্ত গ্যাস ছড়াচ্ছে । তাছাড়া যানবাহনের চালকদের কাণ্ডজ্ঞানহীন ভেঁপু বাজানাে তীব্র শব্দদূষণ ঘটাচ্ছে ।

পরিবেশ দূষণের প্রতিরােধ:

যেহেতু পরিবেশকে আমরা নিজেরাই দূষিত করি , সেহেতু একে দূষণমুক্ত রাখার জন্য আমাদেরকেই সচেষ্ট হতে হবে । বায়ুদূষণ প্রতিরােধকল্পে অধিক পরিমাণে গাছপালা লাগাতে হবে , যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাস পরিহার করে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করতে হবে , ইটের ভাটায় লম্বা চিমনী ব্যবহার করতে হবে । এবং জীবজন্তুর মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে রাখতে হবে । পানিদূষণ রােধের জন্য কল কারখানার বর্জ্য পদার্থ নদ - নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে । জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক ওষুধ যাতে খাল - বিল বা নদীতে না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে । শব্দদূষণ রােধে জনবসতি এলাকায় বিকট শব্দে হর্ণ বাজান যেমন নিষিদ্ধ করতে হবে , তেমনি বিকট শব্দে লাউডস্পিকার , মাইক , রেডিও , টেলিভিশন ইত্যাদি বাজানাে নিষিদ্ধ করতে হবে , যাতে জনসাধারণের অসুবিধার উৎপত্তি না ঘটে ।

পরিবেশ দূষণের প্রতিকার :

নিম্নে পরিবেশ দূষণের প্রতিকার সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে :
ক. সচেতনতা বৃদ্ধি : প্রথমেই পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে । যাতে তারা অবাধে বৃক্ষনিধন , অতিরিক্ত সার - কীটনাশক ব্যবহার ও যত্রতত্র মল - মূত্র ত্যাগ থেকে বিরত থাকে ।
খ. যুদ্ধংদেহী মনােভাব পরিহার : বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যদি অত্র প্রতিযােগিতা ও যুদ্ধংদেহী মনােভাব পরিহার করেন তাহলে পরমাণু ও রাসায়নিক অস্ত্রজনিত পরিবেশ দূষণ থেকে বিশ্ববাসী রক্ষা পাবে ।
গ. জনসংখ্যা বৃদ্ধি রােধ : বিশ্বের লাগামহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি রােধ করতে না পারলে পরিবেশ দূষণ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয় । জনসংখ্যাকে কাম্য সংখ্যার মধ্যে রাখতে পারলে পরিবেশ সুস্থতা ফিরে পাবে ।
ঘ. বৃক্ষরােপণ : বৃক্ষনিধন বন্ধ ও প্রচুর বৃক্ষরােপণ করে পরিবেশের সুস্থতা ফিরিয়ে আনা যায় । সেজন্য বৃক্ষরােপণকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে ।
ঙ. উন্নত যান্ত্রিক কৌশল আবিষ্কার : শিল্পক্ষেত্রে আরাে উন্নত যান্ত্রিক ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে হবে যাতে বর্জ্যে বিষাক্ত পদার্থের মাত্রা কম থাকে । তাছাড়া বর্জ্য নির্মূল ও অপসারণেও উন্নততর ব্যবস্থাপনার জন্যে গবেষণা চালাতে হবে ।
চ. যান্ত্রিক গাড়ির ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণ : পরিবেশ দূষণ রােধ করার জন্যে তরল জ্বালানিচালিত যান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে হবে । কেননা , শহরে পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে যান্ত্রিক গাড়ির ধোয়া সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে । যন্ত্রবিহীন যানবাহন ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে ।
ছ. সামাজিক আন্দোলন : পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে এক দুর্বার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে । আশার কথা , বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিবেশবাদী সংগঠন গড়ে উঠেছে । গ্রিন পীসের কর্মীরা পরমাণু পরীক্ষাসহ পরিবেশ ধ্বংসকারী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে । অন্যদিকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছে ।

পরিবেশ দূষণের কুফল:

পরিবেশ দূষিত হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয় । ফলে অনাবৃষ্টি , অতিবৃষ্টি , ঝড় - ঝঞা ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেয় । উদাহরণস্বরূপ , দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে মাটিতে পানির স্বাভাবিক স্তর অনেক নিচে চলে যায় । ফলে ওপরের স্তরের মাটি রসহীন হয়ে পড়ে । মাটি রসহীন হয়ে পড়লে গাছপালার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে না এবং ফসলাদি ঠিকমত হয় না । ফসলাদি ঠিকমত না হলে খাদ্যাভাব দেখা দেয় । আবার গাছপালার অভাবে জীবজন্তুরও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে । সুতরাং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে মানুষ ও জীবজন্তু উভয়ের জীবন ধারণের পক্ষে ব্যাঘাত ঘটে । ইদানিং জানা যাচ্ছে , বায়ুমণ্ডলের ওপরের ওজোন স্তর বায়ু দূষণের ফলে ক্রমেই অধিক পুরু হয়ে যাচ্ছে । ফলস্বরূপ , সূর্যের তাপ ঠিকমত বিকিরিত হতে না পেরে পৃথিবীর স্থলভাগ আরাে অধিক উত্তপ্ত হয়ে উঠবে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় দুই মেরু প্রদেশের পুঞ্জীভূত বরফের স্তর গলে গিয়ে সারা বিশ্বব্যাপী মহাপ্লাবন ঘটবে ।

উপসংহার :

এই বিশ্বকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে বসবাসের উপযােগী করে রাখতে হলে আমাদের সবাইকে পরিবেশ সচেতন হতে হবে । মনে রাখতে হবে , আমাদের বসবাসের জন্যে পৃথিবী একটাই এবং এই ছােট্ট পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের দায়িত্ব । কবি সুকান্তের ভাষায়-

“ এ বিশ্বকে সবার কাছে বাসযােগ্য করে যাব আমি-
এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার । ”

আরো পড়ুন: