প্রবন্ধ রচনা: আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীসমাজের ভূমিকা 

আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীসমাজের ভূমিকা

এছাড়াও আরো যে বিষয়গুলো সম্পর্কে লিখতে পারবে:
👉🏻অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নারীসমাজ
👉🏻বাংলাদেশের অর্থনীতি ও নারীসমাজ
👉🏻অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অবদান

ভূমিকা :

সভ্যতার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল এবং উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছিল তখন নারীর ভূমিকাই ছিল অগ্রণী । কৃষিকেন্দ্রিক সমাজে নারীই ছিল উৎপাদনের মূলশক্তি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্বে । কালে শিল্পবিপ্লবের অভিঘাতে উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসে । নারী ছিটকে পড়ে উৎপাদনশীল কর্মকান্ডের স্রোতোধারা থেকে । সামগ্রিক অর্থনীতিতে কৃষির অবদান হ্রাস পাওয়া ছাড়াও সমাজের ওপর পুরুষদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর নারীরা ধীরে ধীরে গৃহমুখী হয়ে পড়ল । অবশ্য আধুনিককালে নারীরা আবারও আত্মবিকাশের ধারায় পুরুষের সমান্তরালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে ।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধারণা :

অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি ব্যাপকভিত্তিক ও বিশেষ জ্ঞাননির্ভর প্রত্যয় । তবে সাধারণভাবে আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে বুঝি , যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের এমন একটি ইতিবাচক ও নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তন যার ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের আর্থিক সামর্থ্যা বৃদ্ধি পায় । মাথাপিছু আয় , জীবনমান , ক্রয়ক্ষমতা , শিক্ষা , স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোর ক্রমোন্নতিই অর্থনৈতিক উন্নতির প্রধান বৈশিষ্ট্য । ধীর লয়ে এবং কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হলেও আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে । দেশের অসংখ্য চাহিদা ও সমস্যার সমাধান করা ছাড়াও মানুষের জীবনমান বৃদ্ধি এবং দেশকে টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে । ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের সমাজ পুরুষপ্রধান এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণ তাদেরই হাতে । নারীর প্রতি সর্বময় বৈষম্যের কারণেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অবদানকে সামাজিকভাবে স্বীকার করা হয় না ।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অবদান :

দেশের মোট জনশক্তির অর্ধেকই নারী । দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তথা উৎপাদন ও সেবার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা পুরুষের চেয়ে কম নয় । দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাথে নারীসমাজকে যত বেশি সম্পৃক্ত করা যাবে আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রয়াস তত সফল হবে । নারীরা যেসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে তার কয়েকটি দিক নিম্নে চিহ্নিত করা হলো :

গৃহস্থালির কাজে :

সনাতনভাবে আমাদের দেশের গৃহস্থালির কাজকর্মে নারীরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে । রান্নাবান্না , ঘর - দোর , কাপড় - চোপড় পরিষ্কার করাসহ গৃহব্যবস্থাপনার ষোল আনাই নারীর ওপর নির্ভরশীল । সন্তান লালন - পালন ও পরিচর্যায় মায়ের বিকল্প নেই । শুধু তাই নয় , পরিবারের উপার্জিত অর্থের সুষ্ঠু ব্যয় ও চাহিদা পূরণের কাজটিও আমাদের নারীরাই করে থাকে ।

কৃষিক্ষেত্রে :

ঐতিহ্য অনুযায়ী আমাদের পুরুষরা মাঠে ফসল বপন - রোপণ , বর্ধন ও কর্তনের কাজটি করে থাকে । তবে উপজাতীয় এবং ক্ষেত্রবিশেষ গ্রামবাংলার অনেক পরিবারেই মহিলারা মাঠের কাজে অংশ নেয় । এছাড়া ফসল মাড়াই , প্রক্রিয়াকরণ , গোলাজাতকরণ ও সংরক্ষণের কাজগুলো প্রধানত মেয়েরাই করে থাকে । সার্বিকভাবে পুরুষের কৃষিকর্মের পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে মেয়েদের অবদানও কম নয় । কেননা , শস্যকে খাদ্যোপযোগী করার সকল প্রক্রিয়ার কাজ সাধারণত নারীই করে থাকে ।

গৃহকেন্দ্রিক পশুপাখি পালনে :

বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামীণ বাড়িতে হাঁস - মুরগি প্রতিপালিত হয় । এগুলো থেকে প্রাপ্ত ডিম ও মাংস পরিবারের আমিষের চাহিদা পূরণ করে থাকে । অনেক সময় হাঁস - মুরগি বিক্রি করে পরিবারের অভাব মোচন করা হয় । গবাদিপশুর লালন পালন , দুখ আহরণ ও বিক্রি মহিলারাই করে থাকে । গৃহকেন্দ্রিক এ পশুপাখি পালন থেকে জাতীয় আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসে থাকে- যদিও তার স্বীকৃতি আজ পর্যন্ত হয় নি । গৃহকেন্দ্রিক শাকসবজি উৎপাদনে গ্রামেগঞ্জে আমাদের মেয়েরা ঘরের চালে , আঙিনায় এবং ভিটেমাটিতে শাকসবজির চাষ করে থাকে । এগুলো পরিবারের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদার বিরাট অংশ পূরণ করে ।

কুটির শিল্পে অবদান :

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের মূল চালিকাশক্তি নারী । মৃৎ শিল্প , বাঁশ - বেত শিল্প , সূচি শিল্প , ইকেবানা প্রভৃতিতে মেয়েদের হাতেই মূল উৎপাদন ক্ষমতা । অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের মূল উৎপাদকের ভূমিকা পালন করে মেয়েরা , আর পণ্য বাজারজাতকরণের ভূমিকায় থাকে পুরুষ । তাঁত শিল্পে মেয়েদের অবদান অগ্রগণ্য । উপজাতীয় মেয়েরা নিজ হাতে তাদের কাপড় তৈরি করে । এছাড়া আজকাল শৌখিন ও দর্শনীয় পণ্য মেয়েরা ঘরে বসেই উৎপাদন করে থাকে ।

নির্মাণ খাতে :

আমাদের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু খাত হচ্ছে নির্মাণ খাত । এ খাতেও মেয়েরা পালন করছে সক্রিয় ভূমিকা । ইটের ভাটা , মাটি কর্তন , ইট ভাঙা , ইট সুরকি পরিবহণ। প্রভৃতি কাজে নারী শ্রমিকদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ।

তৈরি পোশাক শিল্পে :

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি তথা তৈরি পোশাক শিল্প । দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৭৯.৬ ভাগই আসে এ শিল্প থেকে । এ শিল্পে নিয়োজিত ১৮ লক্ষ শ্রমিকের শতকরা ৮৫ থেকে ৯০ ভাগই মহিলা । এই বিপুল সংখ্যক মহিলা শ্রমিকের নিরন্তর শ্রমই বাংলাদেশকে আজ উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়েছে ৷

উৎপাদনমুখী শিল্পখাতে :

সম্প্রতি গঠিত রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে অধিকাংশ শিল্পকারখানাতেই নারী শ্রমিকদের সংখ্যা অধিক ৷ তাছাড়া প্যাকেজিং , ওষুধ , বয়ন ও খাদ্য শিল্পে নারীরা পুরুষের চেয়ে অধিকতর দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে । যেকোনো হালকা শিল্পে মেয়েরা পুরুষের চেয়ে অধিকতর উৎপাদন সহায়ক বলে প্রতীয়মান হয়েছে ।

সেবা খাতে :

আমাদের সেবা খাতের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে নারীদের উপযোগিতা অপরিহার্য । চিকিৎসা সেবায় নারীদের বিকল্প নেই । এছাড়া হোটেল , আর্থিক প্রতিষ্ঠান , আকাশ পরিবহণ , কর্পোরেট অফিস প্রভৃতি ক্ষেত্রে মেয়েরা তাদের দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে । এছাড়াও তথ্য যোগাযোগ ও বিনোদন খাতে আজকের আধুনিক নারীদের অবদান অনস্বীকার্য ।

বস্ত্র ও ফ্যাশন শিল্পে :

আধুনিককালে ফ্যাশন সচেতন মানুষের জন্য নিত্যনতুন হাল ফ্যাশনের পোশাক ডিজাইন ও তৈরির কাজে ব্যাপকভাবে মেয়েরা অংশগ্রহণ করছে । আজকাল উদ্যোগী মেয়েরা অনেক ফ্যাশন হাউজ পরিচালনা করছে । তাছাড়া বিউটি পার্লার , রুন্ধন শিল্প , সেলাই প্রশিক্ষণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মেয়েদের অবদান একচ্ছত্র । এছাড়াও আজকাল উন্নত ও আধুনিক বিপণিবিতানে মেয়েরা কাজ করছে ।

জাতি গঠনমূলক কাজে ও জনপ্রশাসনে :

আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষার শতকরা ৭০ ভাগ শিক্ষকই মহিলা । তাছাড়া বিদ্যালয় , মহাবিদ্যালয় , বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষায়িত শিক্ষায় মহিলাদের দক্ষতা ও কৃতিত্ব বিস্ময়কর । আজকাল প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত নারীরা অলংকৃত করছে । তারা ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার , বিচারক , ব্যারিস্টার এমনকি শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে জাতি গঠনে সফলকাম হচ্ছে ।

উপসংহার :

সত্যি কথা বলতে গেলে আজকের বিশ্বে প্রথা ও রীতির পরিবর্তন ঘটেছে । পরিবর্তন ঘটেছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারী পুরুষের অংশগ্রহণমূলক শ্রেণি পার্থক্য । আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের অবদান খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই । এমনকি আজকের নারী অর্থোপার্জনের জন্যে বিদেশেও পাড়ি জমাচ্ছে । আমরা যদি আরও দ্রুত উন্নতি অর্জন করতে চাই এবং বিশ্বের বুকে সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাই তাহলে নারীদের অর্থনেতিক কর্মকাণ্ডে আরও অধিক পরিমাণে সম্পৃক্ত করতে হবে ।