প্রবন্ধ রচনা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

এছাড়াও আরো যে বিষয়গুলো সম্পর্কে লিখতে পারবে:
👉জাতির জনক বঙ্গবন্ধু
👉শেখ মুজিবুর রহমান
👉জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান

ভূমিকা:

শত - সহস্র বছরের ইতিহাসে বাঙালির শ্রেষ্ঠতম অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা । আর এই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে , তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা । পাকিস্তান সৃষ্টির অল্প কিছুকাল পরেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে বৈষম্য আর পরাধীনতার গ্লানি । ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে এদেশের জনগণের দ্বন্দ্ব আরও সুস্পষ্ট হয় । নিপীড়িত জাতির ভাগ্যাকাশে যখন দুর্যোগের কালোমেঘ , তখনই শেখ মুজিবুর রহমানের গৌরবময় আবির্ভাব । অসাধারণ দেশপ্রেম ও দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন । কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি তাই ভালোবেসে তাঁকে ' বঙ্গবন্ধু ' উপাধিতে ভূষিত করে।

জীবনকথা:

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । পিতা শেখ লুৎফর রহমান , মাতা সায়রা খাতুন । দুই ভাই , চার বোনের মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন সবার বড় । পারিবারিক আনন্দঘন পরিবেশে টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর শৈশব - কৈশোরের দিনগুলো কাটে । গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর তিনি গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন । এই সময় তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন । শেরে বাংলা এ . কে . ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে এক সংবর্ধনা সভা শেষে ফিরে যাচ্ছিলেন , পথরোধ করে দাঁড়ালেন শেখ মুজিব । স্কুলের ছাত্রাবাস জরাজীর্ণ । ছাত্রাবাস মেরামতের জন্য অর্থ চাই । শেরে বাংলা প্রথমে কিশোর মুজিবের সাহস ও স্পষ্ট বক্তব্য আর জনহিতৈষী মনোভাবের পরিচয় পেয়ে অবাক হন । তারপর সহাস্যে জিজ্ঞেস করেন , ছাত্রাবাস মেরামত করতে কত টাকা দরকার ? স্পষ্ট কণ্ঠে কিশোর বললেন— বারো'শ টাকা । শেরে বাংলা এ . কে . ফজলুল হক সাথে সাথে টাকার ব্যবস্থা করলেন । বাল্যকাল থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান একটু অন্যরকম ছিলেন । একবার নিজের বাড়ির গোলার ধান গ্রামের গরিব চাষিদের মাঝে বিলিয়ে দেন । পিতা শেখ লুৎফর রহমান এর কারণ জিজ্ঞেস করলে , উত্তরে তিনি বলেছিলেন , ' এবার চাষিদের জমির ধান সব বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে । আকালে পড়েছে কৃষক । আমাদের মতো ওদের পেটেও ক্ষুধা আছে । ওরাও আমাদের মতো বাঁচতে চায় । ' বাবা ছেলের এই সৎসাহস ও মহানুভবতা দেখে বেশ খুশি হলেন । এভাবে শেখ মুজিবুর রহমান গরিবের বন্ধু আর নিপীড়িত মানুষের হৃদয় জয় করেন ।

কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে আই.এ. এবং ১৯৪৭ সালে বি.এ. পাস করেন তিনি । ১৯৪৬ সালে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন । ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান ক্রমেই নেতা মুজিবে বিকশিত হতে থাকেন । ১৯৪৭ - এ দেশ ভাগের পর তিনি আইন পড়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন । ১৯৪৮ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা । ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তিনি যুগ্ম সম্পাদকের পদ লাভ করেন এবং ১৯৫৩ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন । ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার মন্ত্রিত্ব লাভ করেন । এদেশের মানুষের অধিকার আদায় এবং শোষণ বঞ্ছনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বহুবার গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ হন ।

১৯৬৬ সালে তিনি পেশ করেন বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক মুক্তির সনদ ছয় - দফা । এ সময় নিরাপত্তা আইনে আবার গ্রেপ্তার হয়ে কারারুদ্ধ জীবনযাপন করতে থাকেন । তাঁকে প্রধান আসামি করে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা । ১৯৬৯ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত রেসকোর্স ময়দানের এক নাগরিক সংবর্ধনায় তাঁকে ' বঙ্গবন্ধু ' উপাধিতে ভূষিত করা হয় । ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে । কিন্তু সরকার গঠনের সুযোগ না দিয়ে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১ লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন । এর প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমান গুরা মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন । ৭ ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন-

'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । '

২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঘুমন্ত নিরসত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে । শুরু করে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড । সেই রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে । গ্রেপ্তারের পূর্বে অর্থাৎ ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার । দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয় । ১৬ ই ডিসেম্বর বাঙালির বিজয় সূচিত হয় । ১৯৭২ সালের ১০ ই জানুয়ারি তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন । ১২ ই জানুয়ারি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন । কিন্তু পরাজিত হায়েনার দল তাঁর সাফল্য ও বাঙালির উত্থানকে মেনে নিতে পারে নি । তাই আবার শুরু হয় ষড়যন্ত্র । দেশ যখন সকল বাধা দূর করে এগিয়ে যাচ্ছিল , তখন তিনি দেশীয় ষড়যন্ত্রকারী ও আন্তর্জাতিক চক্রের শিকারে পরিণত হন । ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট সামরিক বাহিনীর তৎকালীন কিছু উচ্চাভিলাষী ও বিপথগামী সৈনিকদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন । শারীরিকভাবে শেখ মুজিবের মৃত্যু হলেও তিনি অমর , অক্ষয় । দেশপ্রেমিক প্রতিটি বাঙালি হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে রয়েছে একটি নাম- শেখ মুজিবুর রহমান । কবি অন্নদাশংকরের ভাষায়-

'যতকাল রবে পদ্মা - যমুনা - গৌরী - মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

অবদান :

দ্বিধাবিভক্ত পরাধীন জাতিকে সুসংগঠিত করে স্বাধীনতা মন্ত্রে উজ্জীবিত করা এবং সঠিক নেতৃত্ব দেওয়া খুবই দুরূহ কাজ । আর এই কঠিন কাজটি বঙ্গবন্ধ খুব সহজেই করতে পেরেছিলেন । স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম সবই পরিচালনা করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান অসীম দক্ষতা ও যোগ্যতায় । তাঁর ছিল মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার মতো অসাধারণ বজ্রকণ্ঠ । অনলবর্ষী বক্তা হিসেবে তাঁর ছিল বিপুল খ্যাতি । এর প্রমাণ পাওয়া যায় ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চের ভাষণে । অকৃত্রিম দেশপ্রেম , সাধারণ জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসা , অমায়িক ব্যক্তিত্ব , উপস্থিত বুদ্ধি তাঁকে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছে । স্বাধীনতার পর তিনি খুব বেশিদিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পান নি । যতটুকু সময় ক্ষমতায় ছিলেন , তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন । ১৯৭২ সালের ১২ ই জানুয়ারি ক্ষমতা লাভের পর কিছুদিনের মধ্যে ভারতীয় বাহিনীর দেশত্যাগ করা এবং মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রসমর্পণ করার ঘোষণা দেন । বিশ্বের ১০৪ টি দেশ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে । বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ , জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ও ইসলামি সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে বঙ্গবন্ধুর আমলে । ১৯৭২ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের নতুন সংবিধান গৃহীত হয় । ব্যাংক , বীমাসহ শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করেন । ১৯৭৪ সালে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথম বাংলায় বক্তৃতা করেন । তাঁর নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছিল বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন স্বাধীনতা । এই স্বাধীনতা বাঙালি জাতির জীবনে সূচনা করেছে এক নবদিগন্ত । আত্মপরিচয়হীন জাতি খুঁজে পেয়েছে তাঁর অস্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা ।

উপসংহার:

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তাঁর দূরদর্শী , বিচক্ষণ এবং সঠিক নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল । তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক । তিনি নিজের স্বার্থকে কখনোই প্রাধান্য দেন নি , জাতির কল্যাণের কথাই তিনি সব সময় ভেবেছেন । জেল , জুলুম ও নির্যাতনের কাছে তিনি কখনো মাথা নত করেন নি । সমস্ত জাতিকে তিনি মুক্তি ও স্বাধীনতার চেতনায় ঐক্যবদ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন । তাঁর আত্মত্যাগ জাতিকে মহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে ।


আরো পড়ুন: