বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য বা রূপসী বাংলাদেশ (প্রবন্ধ রচনা)

বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য বা রূপসী বাংলাদেশ

ভূমিকা :

প্রকৃতির অপরূপ লীলাবৈচিত্র্যের কেন্দ্রভূমি আমাদের বাংলাদেশ । এ দেশের গাছপালা , মাটি - বায়ু - জল , ফুল - ফল , পশু - পাখি আর নদী - নালার মতাে বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ পৃথিবীর আর কোথাও নেই । সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলানিকেতন এ দেশ চিরকাল মানুষকে আকৃষ্ট করেছে , ভাবুক করেছে , মােহিত করেছে । তাইতাে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই-

‘ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি ,
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি ।

ঋতুভেদে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য :

ছয় ঋতুর জালে বােনা আমাদের এই বাংলাদেশ । পর্যায়ক্রমে ঋতুচক্রের আবর্তনে ও বিবর্তনে এ দেশের নিসর্গ প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য এবং মানুষের জীবনধারাও আবর্তিত ও বিবর্তিত হচ্ছে । বাংলাদেশের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণতলে ষড়ঋতু পর্যায়ক্রমে আগমন করে । হাস্যগীত ও নৃত্যে পূর্ণ করে দেয় দেশের তনু - মনপ্রাণ এবং প্রকৃতির বুকে যার অপরূপ অফুরন্ত সৌন্দর্যের বান ।

বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য :

বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ— গ্রীষ্ম , বর্ষা , শরৎ , হেমন্ত , শীত ও বসন্ত । দুই মাস মিলে একেকটি ঋতু ; বৈশাখ - জ্যৈষ্ঠ > গ্রীষ্মকাল ; আষাঢ় - শ্রাবণ > বর্ষাকাল ; ভাদ্র - আশ্বিন > শরকাল ; কার্তিক অগ্রহায়ণ > হেমন্তকাল ; পৌষ - মাঘ > শীতকাল ; ফারুন - চৈত্র > বসন্তকাল ।

গ্রীষ্ম ঋতু :

বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস গ্রীষ্ম ঋতু বলে ধরে নিলেও চৈত্রের শেষ থেকে শরতের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রকৃতিতে গ্রীষ্মের দাবদাহ চলে । গ্রীষ্মের রূপ প্রচণ্ড । রৌদ্রদীপ্ত পৌরুষ তার । প্রচণ্ড খরতাপে উত্তপ্ত করে মৃত্তিকার কোমল বক্ষ । জলাধার শুকিয়ে যায় । মরুতৃষ্ণার হাহাকারে ভরে যায় মাঠ - ঘাট - প্রান্তর । ধুলায় ধূসর ভয়াল গ্রীষ্মের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেেন-

“ দারুণ অগ্নিবান
হৃদয় তৃষ্ণা হানে ।
রজনী নিদ্রাহীন , দীর্ঘ দগ্ধ দিন ।

গ্রীষ্মের কালবৈশাখের দুরন্ত ঝাপটায় প্রকৃতি হয় ক্ষতবিক্ষত । প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা ও ঝড় - বৃষ্টির পর তৃষ্ণাক্ত পৃথিবী শীতল হয় , মাটি ভিজে যায় । ফলে রসাদ্র মাটির কোমল বুকে জেগে ওঠে নবীন তৃণাকুর । আম , জাম , কাঁঠাল , লেবু , আনারস এ ঋতুতে পাওয়া যায় । ঋতু সন্ন্যাসীর প্রখর দীপ্তি গলে পড়ে করুণাধারায় , রুক্ষতার আবরণে সে করে সুন্দরের সাধনা । তারপর শ্যামল সুন্দর বর্ষার আশ্বাস দিয়ে বিদায় নেয় গ্রীষ্ম ।

বর্ষা ঋতু :

ঋতুরঙ্গের পালায় গ্রীষ্মের পরই আসে বর্ষা । এ যেন শুষ্কতার পর সজলতার আবির্ভাব , রুক্ষতার পর শ্যামশ্রীর , শূন্যতার পর পূর্ণতার । সজল মেঘের গুরুগর্জনে কেঁপে ওঠে প্রকৃতির বুক । রিমঝিম বৃষ্টি পড়ার তালে তালে মেতে ওঠে পাখপাখালি । কদম্ব - বর্ষার রাজম্বিক আবির্ভাবকে স্বাগত জানিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন-

ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে
জল সিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভ রভসে
ঘন গৌরবে নবযৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা ।

আষাঢ় - শ্রাবণ বর্ষাকাল হলেও এর দাপট থাকে ভাদ্র পর্যন্ত । বর্ষা প্রকৃতিকে অপরূপ সবুজ শােভায় রাঙিয়ে তােলে । বর্ষা বাঙালি চাষির জন্য আশীর্বাদ । কারণ বর্ষার জলতরঙ্গ না শুনলে ফসলের ফলন ভালাে হয় না । বর্ষা আর বাঙালি এক । এ ঋতু বাঙালির একান্ত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ।

শরৎ ঋতু :

নৃত্য পটিয়সী বর্ষাবালা প্রকৃতির মঞ্চ থেকে বিদায় নেওয়ার সাথে সাথেই আসে শরৎ । প্রকৃতির প্রাঙ্গণে শরৎ ক্ষণিকের অতিথি । ' ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া ’ তার আবির্ভাব । ভাদ্র - আশ্বিন শরৎকাল হলেও আশ্বিনের গােড়া থেকেই সােনা রােদ দেখা দেয় । আবার আশ্বিন শেষ না হতেই সে রােদ মিলিয়ে যায় । কিন্তু ক্ষণজীবী এ ঋতু তার স্বল্পসময়ে প্রকৃতিকে আশ্চর্য রূপলাবণ্যে ভরে দেয় । কবিও গেয়ে ওঠেন-

আজিকে তােমার মধুর মুরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে ।

শরতের আকাশ হয় নির্মল । খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায় । শিশির ভেজা শাপলা , শিউলি আর কাশের গুচ্ছ সােনা রােদে ঝিকিমিকি করে ওঠে । শারদীয় চাঁদের জোছনা - ভেজা বিমূর্ত রাত অপূর্ব । ধন - ধান্যে , পুষ্পে ধরিত্রী হয়ে ওঠে শােভাময়ী । বাঙালি হিন্দুর দুর্গাপূজা , লক্ষ্মীপূজা , দীপাবলি ইত্যাদি বিভিন্ন উৎসবে শরৎ মুখরিত হয়ে ওঠে ।

হেমন্ত ঋতু :

শরতের পরই আসে হেমন্ত । হেমন্ত ক্ষণস্থায়ী ঋতু । কার্তিক - অগ্রহায়ণ দুই মাস হলেও হেমন্তের রূপ - সৌন্দর্য এক পক্ষকালের বেশি উপভােগ করা যায় না । শীতের দোর্দণ্ড প্রতাপে নষ্ট হয় হেমন্তের স্থায়িত্ব । হেমন্ত লক্ষ্মীর বন্দনায় কবিগুরু বলেছেন-

হায় হেমন্ত লক্ষ্মী , তােমার নয়ন কেন ঢাকা
হিমের ঘন ঘােমটাখানি ধূসর রঙে আঁকা ।

শস্যলক্ষ্মী হেমন্ত সােনার ধানের প্রাচুর্যে ধরার আঁচল ভরে দেয় । ঘরে ঘরে চলে নবান্নের উৎসব । পাকা ধানের গন্ধে আকাশ - বাতাস হয় ব্যাকুল । বাংলার ঘরে ঘরে অফুরন্ত আনন্দের অমৃতধারা ঢেলে দিয়ে হেমন্ত লাজনম্র বধূর মতাে কুয়াশায় মুখ ঢেকে বিদায় নেয় ।

শীত ঋতু:

হেমন্তকে মাঝপথে থামিয়ে প্রকৃতির মধ্যে দোর্দণ্ড প্রতাপে আবির্ভূত হয় শীত । পৌষ এবং মাঘ এই দুই মাস শীতকাল । উত্তুরে বাতাসের শৈত্যপ্রবাহে জীবজগতে শুরু হয় থরথরি কম্প । ঝরা পাতার দীর্ঘশ্বাসে বিষয়া হয় পরিবেশ । পত্রপল্লব শূন্য গাছগুলাে যেন অকাল বৈধব্য যন্ত্রণায় মূক হয়ে যায় । শীত বার্ধক্যের জড়রূপ পরিগ্রহ করে । মানুষের কর্মজীবনে আনে শৈথিল্য ও জড়তা । শীত রুক্ষ কঠোর শ্রীহীন , কিন্তু নিঃস্ব নয় । কারণ শীত সােনার ধানে আঙিনা ভরার ঋতু । কবি শীতের এ কর্মব্যস্ত রূপের বন্দনা গেয়ে বলেছেেন-

পৌষ তােদের ডাক দিয়েছে ,
আয়রে চলে , আয় আয় আয় ।

এছাড়া শীতে প্রচুর শাকসবজি , নতুন গুড় পাওয়া যায় । পিঠাপুলির এ ঋতু ভােজনবিলাসী বাঙালির কাছে অত্যন্ত প্রিয় ।

বসন্ত ঋতু :

নবযৌবনের বার্তাবাহী ঋতুরাজ বসন্ত । রিক্ত শীতের পরেই ঋতুরাজ বসন্তের রাজকীয় আবির্ভাব । জীর্ণ , জ্বরা ঝরিয়ে দিয়ে নবযৌবনের বার্তা বহন করে নিয়ে আসে মধুমাস বসন্ত । শীতে আড়ষ্ট প্রকৃতি যেন বর্ণাঢ্য বরণমালা নিয়ে স্বাগত জানায় বসন্তকে-

আজি দখিনা দুয়ার খেলা
এসাে হে এসাে , হে আমার বসন্ত এসাে ।

ফারুন - চৈত্র দুই মাস বসন্ত কাল । গাছে গাছে সবুজ পাতার সমারােহ । বাতাবি লেবুর ফুল আর আম্রমুকুলের গন্ধবাহী পাগলপারা বাতাস , মধুপের গুঞ্জন , কবির মনে জাগে ছন্দ , আর গায়কের মনে জাগে গান , কোকিলের কুহু রব প্রকৃতিকে ডাক দেয় অফুরন্ত আনন্দের প্রাণপ্রাচুর্যে ।

বাংলাদেশের জনজীবনে ঋতুবৈচিত্রের প্রভাব :

বাংলাদেশের জনজীবনে ঋতুবৈচিত্র্যের সবচেয়ে বড় প্রভাব লক্ষ করা যায় বাঙালির পেশাগত জীবনে । ঋতুভেদে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফসল ফলান বাংলার কৃষক । গ্রীষ্মকালে এক ধরনের সবজি লাগান , বর্ষাকালে অন্য ধরনের , শীতকালে ভিন্নতা দেখা যায় । আবার অর্থকরী ফসল ফলানাের সময়ও ঋতুভেদে আলাদা । তবে শুধু কৃষকজীবনেই নয় , অন্য পেশাতেও ঋতুভেদে দেখা যায় বৈচিত্র্য । আবার বর্ষা শহরের মানুষের কর্মচাঞ্চল্যে বিঘ্ন ঘটায় । ধনীদের জন্য আরামের দিন কাটানাের উপযুক্ত সময় বর্ষা আর শীত । কিন্তু বর্ষায় আর শীতে দরিদ্ররা কষ্ট পায় । তবে সেদিক থেকে আরামদায়ক ঋতু বসন্ত । বসন্তের বাতাসে আরামের আমেজ থাকে । হেমন্তের শীত আমেজও মন্দ নয় । তবে গ্রীষ্ম ও বর্ষায় জ্বর , আমাশয় , কলেরা , ডায়রিয়া , বসন্ত ইত্যাদি রােগের প্রকোপ বাড়ে । তবে রােগশােক যা - ই থাকুক - বাঙালি উৎসব — প্রিয় জাতি । তাই নানা ঋতুতে নানা উৎসবের আমেজ বাংলার জনজীবনকে দেয় ভিন্ন মাত্রা ।

বাঙালির সংস্কৃতিচর্চা ও সাংস্কৃতিক জীবনে ঋতুবৈচিত্র্যের প্রভাব :

ঋতুবৈচিত্র্য বাঙালির সংস্কৃতিচর্চা ও সাংস্কৃতিক চেতনাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা । বাংলাদেশের বহু কবি ও সাহিত্যিকদের জীবনে ও লেখনীতে ঋতুবৈচিত্রের প্রভাব লক্ষ করা যায় । প্রকৃতি প্রতি দুই মাস পর পর তার খােলস পাল্টিয়ে নতুন পােশাক পরার সাথে সাথে সাহিত্যিকরা যেন সেই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে নানাভাবে লেখনীকে ধারণ করেন । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পাই-

এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘাের বরিষায় ।

আবার শরৎচন্দ্রের মহেশ ’ গল্পে দেখি গ্রীষ্মের দাবদাহে নিদারুণ পল্লিসমাজ । সুফিয়া কামাল হেমন্তকে নিয়ে মেতে ওঠেন নতুনের আনন্দে-

“ এইতাে হেমন্তের দিন , দিল নব ফসলের সম্ভার
অজানে অঙ্গনে ভরি এই রূপ বাংলার । ”

আবার সুফিয়া কামালকেই শীত ঋতুকে নিয়ে হয়ে উঠতে দেখি নিজ স্মৃতিকাতরতায় মগ্ন । সুকান্তের কবিতায় নতুনের আহ্বান পাই-

‘ নতুন ফসলে সুবর্ণ যুগ আসে ।

শুধু তাঁরাই নন , বাংলার এমন কোনাে কবি বা সাহিত্যিক খুঁজে পাওয়া যাবে না , যার মন বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য আন্দোলিত করেনি । মােটের ওপর সবাই বাংলার রূপ ও সৌন্দর্য নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন , যার মূল উপজীব্য বাংলার রূপবৈচিত্র্য । বাংলার সাহিত্য সম্ভার এত সমৃদ্ধ হতাে না যদি বাংলার রূপ ও বৈচিত্র্যে ঋতুচক্রের এ রকম সুস্পষ্ট প্রভাব না থাকত । আবার বাঙালির সংস্কৃতি যেন বাংলার ঋতুচক্রের সাথেই পায় পর্যায়ক্রমিক নতুনত্ব ও ভিন্ন মাত্রা ।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ঋতুবৈচিত্রের প্রভাব :

বাংলাদেশের প্রকৃতিতে যেমন বিচিত্র সৌন্দর্য আছে , তেমনি আবার আছে দুর্যোগের অভিশাপ । ঋতুভেদে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও ভিন্ন হয় । গ্রীষ্ম ও বসন্তে ঘূর্ণিঝড় , কালবৈশাখী ঝড় , জলােচ্ছাসের সম্ভাবনা বাড়ে । আর বর্ষা ও শরতে অতিবৃষ্টি , বন্যার মতাে বিপর্যয়ও আসতে পারে । গ্রীষ্মকালে খরা ও অনাবৃষ্টি হতে পারে । অর্থাৎ ঋতুভেদে দুর্যোগের পরিবর্তন হয় । তবে সাম্প্রতিক আলােচিত দুর্যোগ ভূমিকম্প যেকোনাে স্থানে যেকোনাে সময়েই হতে পারে ।

উপসংহার :

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর লীলাবৈচিত্র্যের পীঠস্থান । অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্যে জীবনের বহুতর প্রসঙ্গে ঋতুর পরিবর্তন বাঙালির মনে আনে আনন্দের অফুরন্ত আভাস । বাংলায় যেমন অপরূপ ঋতুবৈচিত্র্য বিদ্যমান , এমনটি পৃথিবীর আর কোথাও দৃষ্টিগােচর হয় না । ষড়ঋতুই বাংলার প্রকৃতিকে দান করেছে পূর্ণ অভিব্যক্তি ।


আরো পড়ুন: