একটি শীতের সকাল রচনা

একটি শীতের সকাল

প্রিয় পাঠক উপরোক্ত বিষয় সংক্রান্ত ২টি রচনা নিচে দেওয়া হল:

রচনা নম্বার →১


ভূমিকা :

শীত ঋতু বাংলার প্রকৃতি ও মানবজীবনে মিশ্র প্রভাব বয়ে আনে । শীতের সকালে শীত ঋতু প্রকৃতিতে ধরা দেয় দৃষ্টির সীমানায় । কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে শীতের সকাল নতুন আমেজ , নতুন অভিজ্ঞতা বয়ে আনে । রাতের অবসানে দিনের সূচনা হয় সকালের হাত ধরে । সকাল মানে প্রাণের সরব উপস্থিতি , সকাল মানেই আলাের উদ্ভাসন । কিন্তু স্বাভাবিক সকালের সাথে শীতের সকালের পার্থক্য স্পষ্ট । শীতের সকালে প্রকৃতির বুকে জীবন - জাগরণ স্বতঃস্ফূর্ত হয় না । প্রকৃতি ও প্রাণিকুলকে জড়িয়ে থাকে নীরব আড়ষ্টতা । শীতের আগমনে মানুষের মন বলে উঠে -

“ হিম হিম শীত শীত
শীত বুড়ি এল রে
কনকনে ঠাণ্ডায়
দম বুঝি গেল রে । ”

শীতের সকালে প্রকৃতি :

শীতের সঙ্গী কুয়াশা । শীতের রাত ফুরিয়ে গিয়ে দিবসের যখন সূচনা হয় , তখন প্রকৃতির ওপর কুয়াশা ভারি চাদর মেলে দেয় । ঘন কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে যায় প্রকৃতি ও নিসর্গের রূপরাশি । দিনের সূচনা তাই ঝলমলে হয়ে ওঠে না । প্রকৃতিকে গ্রাস করে সীমাহীন পাণ্ডুরতা । এক অর্বাচীন আড়ষ্টতায় প্রকৃতি ঝিমিয়ে থাকে । সূর্যের আকাঙ্ক্ষায় পাণ্ডুর প্রকৃতি হয়ে পড়ে উন্মুখ । কনকনে হিমেল হাওয়া স্তন্ধ প্রকৃতির বুকে হিংস্র কামড় বসিয়ে দেয় ।

গ্রামে শীতের সকাল :

শীতের সকালের সৌন্দর্যময় উপস্থিতিটা ঘটে গ্রামেই । গাছের পাতায় , ধানের শীষে কিংবা ঘাসের ডগায় জমে থাকে শিশিরবিন্দু । পূর্ব আকাশে কুয়াশার ভারি পর্দা ঠেলে সূর্য যখন ক্ষীণ মিষ্টি কিরণ ছড়ায় তখন গ্রামের প্রকৃতি ধারণ করে এক অনন্য রূপ । শীতের সকালে বাগানে প্রস্ফুটিত গােলাপ , বেলি , বকুল , চামেলি সবার মন কেড়ে নেয় । শিশিরবিন্দু মুক্তোদানার মতাে চিকচিক করে ওঠে । মিষ্টি রােদ দেহমনে এনে দেয় অনাবিল সুখাবেশ । নদীবক্ষের প্রমত্ততা যায় থেমে । নীরব - নিথর প্রকৃতির সাথে নদীও যেন একাত্মতা ঘােষণা করে । পানি থেকে উথিত হয় পাংশু ধোঁয়া । শীত নিবারণের জন্যে গ্রামীণ মানুষেরা জড়াে হয় আগুনের পাশে ।

শহরে শীতের সকাল :

গ্রামের মতাে শহরে শীতের সকাল মােহময় রূপে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় না । কেননা এখানে দূর্বাঘাস নেই , নেই ধানের শীষ । সূর্য এখানে ওঠে ইট - কাঠের তৈরি দালানের আড়ালে । সকালে যখন গাড়ির বাতি জ্বলে কিংবা পৌর বাতির আলাে জ্বলতে থাকে তখন কুয়াশা আবৃত শহরের পান্ডুরতাই শুধু তীব্র হয়ে ওঠে । শহুরে মানুষের আয়েশী জীবনে সকাল চলে যায় ঘুম - তন্দ্রায় । দেখা হয় না প্রকৃতির রূপ । শুধু দৃষ্টিবিভ্রমে পড়া কাকের কর্কশ কলরবে বােঝা যায় সকাল হয়েছে ।

শীতের সকালের পিঠাপুলি :

শীতের সকালে কৃষকদের মাঝে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায় । এমন সময় কৃষাণীও বসে থাকে না । সে ধান ভেনে চাল কুটে পিঠা তৈরির জন্য প্রস্তুত হয় । ফসল তুলে ঘরে আনলেই শীতের পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায় । শীতের সকালে পিঠা তৈরির সময় মৌ মৌ সুগন্ধ ভেসে এলে মন আনন্দে ভরে ওঠে । পিঠে খাওয়ার আনন্দে উদ্বেলিত কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে-

“ পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে , আরও উল্লাস বাড়িয়েছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে । ”

খেজুর গাছ থেকে নামে টাটকা রস । ঘরে ঘরে তৈরি হয় রসের পায়েশ । রসনা বিলাসের জন্যে শীত ঋতুর কোনাে তুলনা নেই ।

ধনী ও গরিবের শীতের সকাল :

ধনীর জন্য শীতের সকাল মিষ্টি মধুর লগ্ন । রঙ - বেরঙের গরম কাপড়ের নিচে শরীর লুকিয়ে ধনীরা সুখানুলভ করে । পিঠাপুলির স্বাদ নেয় পরিতৃপ্তিতে । শীতের আমেজে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ধনীরা লাভ করে অমৃতের স্বাদ । কিন্তু গরিবের কাছে শীতের সকাল এক অবাঞ্ছিত বিড়ম্বনা মাত্র । যাদের কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই , ভােরের ভারি বাতাস তাদের হাড়ে নির্মমভাবে কামড় বসায় । ঠরঠর করে কাঁপতে থাকে মানবসন্তান । প্রতিবছর শীতকালে গ্রামবাংলার আনাচে - কানাচে অনেক শীতার্ত মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে । শহরের ফুটপাতে শীতের সকালে দেখা যায় কুকুর ও টোকাইদের জড়াজড়ি করে শীত নিবারণের আদিম প্রচেষ্টা ।

শীতের সকালের ভাবরূপ :

বাংলা কাব্যে শীতের স্থান কম , বর্ষার প্রাধান্য লক্ষণীয় । মেঘ - মেদুর বিরহী চিত্তহারিণী বর্ষা , শরতের স্বর্ণমাধুর্য , বসন্তের আনন্দ হিল্লোলে মুখরিত কবিকুল । রিক্ত , বৃক্ষ , কঠোর ও শ্রীহীন শীত । তবু তারও আছে আপন সম্পদ - সরষে ক্ষেতের শীত মাধুরী , অতসী , গাঁদা , দোপাটি , ডালিয়ার রূপের ডালি - তৃণশীর্ষে একটি শিশিরবিন্দু । সত্যি শীতের সকাল বড়ই আমেজি । কী গ্রামে , কী শহরে শীতের রাত শেষ হলেও ভােরের আমেজ তাতে আসে না । অপূর্ব শান্ত প্রকৃতি ভােরের আবছা আলো - আঁধারিতে কেমন যেন রহস্যঘন রূপ ধারণ করে হাতছানি দেয় প্রকৃতির উদার বুকে আশ্রয় নিতে । কিন্তু শহরে কোথায় সে অনন্ত আকাশের নিঃসীমতা যেখানে হারিয়ে যাব ।

শীতকালের বিপত্তি :

শীতের সকালে পরিবেশ কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে । ফলে অল্প দূরেও স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না । মনে হয় কুয়াশার সাদা পর্দা ছাড়া সামনে কিছু নেই । কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থায় সড়কপথে বা নৌপথে চলাচল হয়ে ওঠে ঝুঁকিপূর্ণ । এ সময় রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচলের ফলে দুর্ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি । নদীপথে লঞ - স্টীমার চলাচলের ক্ষেত্রেও সমস্যা সৃষ্টি হয় । শীতের সকালে হাড় কাঁপানাে শীতে মানুষ ও প্রকৃতি ভােগে জড়তা ও বিষন্নতায় ।

উপসংহার :

আমাদের দেশের আর্থ - সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশে শীতের সকালের অনুভূতি মিশ্র । শীতের সকাল যেমন মিষ্টি মধুর ও উপভােগ্য ; তেমনি দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের জন্যে অবাঞ্ছিত দুর্ভোগের প্রহর । তবে বাংলার প্রকৃতিতে শীতের সকাল যে রূপচ্ছটা ছড়িয়ে দেয় সত্যিই মনােমুখকর ।

রচনা নম্বার→২

কুয়াশার চাদর গায়ে মুড়িয়ে শীতের সকাল হাজির হয় । প্রকৃতি যেন নির্জীব , অসাড় , অলস রূপ ধারণ করে । চারদিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে বলে দূরের জিনিস ঝাপসা , অস্পষ্ট মনে হয় , কিছুই নজরে পড়ে না । বনানীর গাছপালা , তরুলতা শুষ্ক ও পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকে । ঘরে বাইরে সর্বত্র এক নিদারুণ স্থবিরতা - ব্যস্ততার লেশমাত্র কোথাও যেন নেই । এমনি এক ঘােমটা টানা লাজুক নববধূর সাজে শীতের সকালের আবির্ভাব ঘটে । সূর্যের আলাে পাবার আশায় সবাই যেন ব্যাকুল ।

কুয়াশার ঘন আবরণ ভেদ করে সূর্যরশ্মিকে আসতে বড় বেগ পেতে হয় , বােধ হয় , সময়ও বেশী লাগে । তাই রাত অনেক আগে পােহালেও বেলা নয়টা অবধি সূর্যের আলাের দেখা পাওয়া ভার । কেউ কেউ সকাল সকাল লেপ - কাঁথা ছাড়তে চায় না । অনেক গৃহবাসী আগাগােড়া লেপ গায়ে মুড়ি দিয়ে ঘরের মধ্যে চুপটি মেরে শুয়ে থাকে । তবে গৃহত্যাগী গবাদি পশুর হাঁকডাকে প্রভাত হয় । সকাল হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় ।

কিন্তু জীবনের তাড়া আছে , কাজ ছাড়া গতি নেই । তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেরিতে হলেও অনেকে শয্যা ত্যাগ করে ঘর ছেড়ে বের হয় । মুখে - হাতে পানি লাগাতে সবারই যেন অনীহা । বাচ্চাদের তাে কথাই নেই । তারা বিছানা ছাড়তে নারাজ । অগত্যা মা এর বকুনি খেয়ে তারা হাত - মুখ ধুতে বসে । একটু উত্তাপের জন্য তখন যেন সবাই উদগ্রীব । গ্রামে - গঞ্জে রাস্তার মােড়ে বা ঘরের আঙ্গিনার এক কোণে অনেককে আগুন পােহাতে দেখা যায় । বিশেষতঃ , ছেলেপেলে ও বুড়ার দল নাড়ার আগুন জ্বালিয়ে ঘিরে বসে । আগুনের ছােট কুণ্ডলীকে ঘিরে আগুন পােহাতে যে কি আনন্দ !

কাজের তাগিদে কৃষাণ সকাল সকাল শয্যা ত্যাগ করে । মৌসুমী শস্যের আশায় সে তাড়াহুড়া করে মাঠে যায় । কিষাণী ডালা হাতে সবজির ক্ষেতে রওয়ানা হয় । রান্নার জন্য শাকসবজি সংগ্রহে ব্যস্ত হয় । খেজুর গাছের হাড়ির পাশে রসপিপাসু পাখিরা আনন্দে মেতে উঠে । কিন্তু এ আনন্দ বেশীক্ষণ থাকে না । কাক ডাকা ভােরেই ছুটে আসে গাছুয়া , রসের হাঁড়ি নামালে ছুটে আসে ছেলেমেয়ের দল । এ কনকনে শীতেও রসপানের লােভটা কেউ যেন চেপে রাখতে পারে না । রােদে বসে গরম গরম মুড়ি চিবাতে ভারি মজা ! তাই অনেকে কোঁচা ভরে মুড়ি নিয়ে উঠানে বসে বসে মুড়ি চিবায় আর রােদ পােহায় । শিশির - ভেজা দূর্বা এক অপরূপ রূপে ঝলমল করে । সূর্যের আলাে যখন দূর্বা দলের উপর ছড়িয়ে পড়ে , তখন তার হাসিতে যেন মুক্তা ঝরে । এ দৃশ্য বড় সুন্দর , বড় মনমাতানাে ! কিন্তু কে দেখে দূর্বার এ অপরুপ রূপ ? সবাই তখন রােদ - পিয়াসী । কেউ উঠানে বসে , কেউ বা বারান্দায় , কেউ বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রােদ পােহাতে ব্যস্ত । তাই দূর্বা ঘাসের হাসি কেউ না দেখায় সে অভিমানে ম্লান হয়ে যায় । তার মুক্তাঝরা হাসি নিত হয়ে পড়ে ।

শীতের সকালে নদীতীরও আবছা আঁধারে ঢাকা পড়ে যায় । নদীর বুকে কুয়াশা যেন নদী বক্ষ ভেদ করে উপরে উঠে আসে । মনে হয় , পানি যেন সিদ্ধ হচ্ছে আর সেই সিদ্ধ পানি বাষ্পকারে নদীর উপরে উঠে আসছে । মাছখেকো পাখিরা সুযােগের অপেক্ষায় থাকে ।

শীতের সকাল নাগরিক সভ্যতাকেও দোলা দেয় । অফিসে - আদালতে , স্কুল - কলেজে যেতে কারাে যেন তাড়া নেই । কেমন যেন এক গদাই লস্করী চাল । তবু যেতে হয় । গায়ে তেল মেখে কেউ কেউ রোদে গা কিছুটা গরম করে নেয় । তারপর কোন রকমে গায়ে দুই এক বালতি পানি তাড়াহুড়া করে ঢেলে দিয়ে কিংবা পুকুরে ঝুপ করে এক ডুব মেরে গােসলের কাজ শেষ করে ফেলে । অফিসের ব্যালকনিগুলােও ফাকা থাকে না । কাজ ফেলে চেয়ার পেতে অনেককে রােদ পােহাতে দেখা যায় । চায়ের দোকানগুলােতে বেজায় ভীড় । এক কাপ চা না হলে চলে না । শরীর যেন জমে কাঠ হয়ে গিয়েছে । পেটের নাড়িভুড়ি পর্যন্ত যেন জমে গিয়েছে । তাই গরম গরম চা খেয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা করতে অনেকে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে । বাবুরা তাে কোটের ভেতর হতে হাত দুটো বের করতেই নারাজ ।

কিন্তু শীতের এ আড়ষ্টভাব বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না । সূর্যকিরণ কুয়াশা ভেদ করে । দেরিতে হলেও পৌছে । পৃথিবী আলােকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে । বেলা হলে আবার শুরু হয় কর্মজীবনের ব্যস্ততা , জনজীবনের প্রাণ চঞ্চলতা।


আরো পড়ুন: